কুমিল্লার হাতের তৈরি তাঁতের আসল খাদি এখন বিলুপ্তির পথে

প্রকাশিত: ১২:২৬ অপরাহ্ণ, মার্চ ৩০, ২০২৪

খ্যাতি নিয়ে কুমিল্লার খাদির চাহিদা বাড়লেও তাঁতে তৈরী আসল খাদি এখন বিলুপ্তির পথে। একসময় বৃহত্তর কুমিল্লা অঞ্চলে হাজার হাজার তাঁতী খাদি কাপড়ের সরবরাহের সাথে জড়িত থাকলেও এখন আছে মোটে ৮টি তাঁত। গবেষকরা বলছেন, তাঁতের আসল খাদির চাহিদা আছে সব সময়ই, তবে কাঁচামালের অভাবে বিলুপ্ত প্রায় তাঁতের খাদি ফিরিয়ে আনতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। শেষ প্রজন্মে তাঁতের দক্ষ কারিগর যারা টিকে আছেন তাদের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা করা গেছে মসলিনের চেয়েও সহজে খাদিও উত্তরণ সম্ভব বলে মনে করেন তারা।

কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার, চান্দিনা এবং মুরাদনগর উপজেলা থেকে তাঁতে তৈরী খাদি কাপড় একসময় সুনাম অর্জন করে অবিভক্ত ভারতবর্ষসহ সারা বিশে^। বাংলাদেশের পোশাকের ব্র্যান্ড হিসেবে কুমিল্লার খাদির কদর এখনো কমেনি। তবে কালের আবর্তনে কারিগরের হাতে তাঁতের তৈরী আসল খাদি বা হ্যা-লুমের খাদি এখন বিলুপ্ত। শেষ প্রজন্মের দুই একজন তাঁতী আর তাঁতের দেখা মেলে কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার বড় কামতা গ্রামে। কুমিল্লার আদি এবং আসল খাদির কারিগর দেবিদ্বার বরকামতা গ্রামের চিন্তাহরন দেবনাথ ও রণজিৎ দেবনাথ। ৭০ এর দশক থেকেই খাদিও সুতা ও কাপড় তৈরীতে জড়িত তারা। সত্তোরোর্ধ্ব এই দুই জন সম্পর্কে ভাই এবং তাদের এই গোষ্ঠীর মাধ্যমেই কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় খাদিও তাঁতের কারিগররা ছড়িয়ে পড়েন বলে দাবি তাদের। আসল খাদির এই তাঁতীরা বলছেন, এই অঞ্চলে এক সময় হাজার হাজার তাঁত থেকে সারা দেশে খাদির কাপড় সরবরাহ করা হত। তুলা আর দক্ষ কারিগরের অভাবে এখন আর তাঁতের খাদি নেই। মেশিনে তৈরী খাদি পরেই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাচ্ছেন সবাই।

 

চিন্তাহরন দেবনাথ জানান, মেশিনে বানানো খাদি আর তাঁতের খাদি দেখতে একই রকম কিন্তু মানের অনেক তফাত। যারা আসল খাদি চিনে তারা সেটি খুঁজেই কিনে নিয়ে পরে। তাঁতের খাদি দিয়েই কুমিল্লার খাদি বিশে^ সম্মান পায় আর এখন সেই তাঁতই বিলুপ্ত। কুমিল্লাতে তিনটি দোকানে পাওয়া যায় আসল খাদি। তাও খুব কম পরিমানে। এখন তাঁতই নাই যে খাদি বুনে দিবে।

 

তিনি জানান, একসময় কুমিল্লাদেবিদ্বার চান্দিনা মুরাদনগর এলাকায় হাজার হাজার তাঁতি ছিল। হাজার হাজার নারী চরকায় খাদির সুতা কেটে আয় করতো। পরিবারের ভরণ পোষন চলতো স্বচ্ছলভাবে। খাদির রমরমা ব্যবসায়ী কুমিল্লা থেকে সারাদেশ তথা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও খাদির পোশাক রপ্তানি হতো। আর এখন উপজেলায় কয়েকটা তাঁত খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে।

রণজিৎ দেবনাথের তাঁতের ঘরে ছিলো ৮টি তাঁত। একটি ছাড়া সবই বন্ধ। শখের বশে দুই এক থান বুনেন তিনি। তাঁতে বসেই জানালেন, খাদির প্রজন্ম এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। এখনই খাদি উত্তোরণে পদক্ষেপ না নেয়া হলে আসল খাদির সুতা কাটা ও বুনন হারিয়ে যাবে। তুলা সরবরাহ করা গেলে আর সুতার কাটার কারিগরদের ভর্তুকি দিয়ে মজুরির ব্যবস্থা করা গেলেই আবারো জোয়ার আসবে আদি খাদির। তাঁতের খাদি দাম হলেও চাহিদা আছে। দরকার হলে বেশি দামে বিক্রি করেই এই কাপড়ের দাম ওঠানো সম্ভব। কিন্তু খাদি বলে মেশিনে তৈরী কাপড় বিক্রি প্রতারণার শামিল।

 

রণজিৎ দেবনাথের দাবি, খাদি শুধুমাত্র কুমিল্লা অঞ্চলের কাপড়। আদিকাল থেকেই এই অঞ্চলের মানুষ কাপড় তৈরীর যে পেশাদার সংস্কৃতি চালু করেছিলো- তারই একটি অংশ খাদি। মহাত্মা গান্ধীর স্বদেশী আন্দোলনের সময় তা প্রসার পায়। কুমিল্লার খাদি এবং ভারতীয় খাদির মধ্যে বুননে পার্থক্য আছে। কুমিল্লার খাদি শুধু কুমিল্লারই।

 

কুমিল্লার বিশুদ্ধ খদ্দর ভান্ডার, খাদি ভবন, খাদি ভূষনসহ কয়েকটি দোকানে পাওয়ায় যায় হাতে তৈরী আসল খাদি। এসব খাদি কাপড় মানে যেমন অনন্য তেমনি দামেও বেশি। তারপরও তাঁতের আসল খাদির চাহিদা মেশিনের খাদির চেয়ে বেশি বলেই মনে করেন সৌখিন খাদি ক্রেতা ও দোকানিরা। কুমিল্লার ইতিহাসবিদগণ জানান, ভারতীয় উপমহাদেশের কুমিল্লার তাঁতের খাদি এই অঞ্চলের একটি মৌলিক পণ্য যা সারা বিশে^ সুনাম অর্জন করে। ঐতিহ্য হিসেবে মসলিনের মতই খাদিকে পুনরুদ্ধার করা প্রয়োজন।

ইতিহাসবিদ আহসানুল কবির বলেন, খাদি শুধু কাপড় কিংবা পোষাক নয়- এটি দেশ প্রেমের অনবদ্য দলিলও। বহুকাল আগেও যে কুমিল্লা অঞ্চল একটি সমৃদ্ধ জনপদ ছিলো- তার প্রমান। সরকার চাইলেই মসলিনের মত প্রকল্প ভিত্তিক উন্নয় কার্যক্রম হাতে নিয়ে খাদির উত্তোরণ ঘটাতে পারে।

জেলা প্রশাসক খন্দকার মু. মুশফিকুর রহমান জানান, কুমিল্লার আসল খাদি কাপড়কে পুনরুদ্ধারের বিষয়টি পাট ও বস্ত্র মন্ত্রনালয়কে গুরুত্বের সাথে জানানো হবে। এছাড়া কুমিল্লার খাদির ভৌগলিক সত্ত্ব জিআই স্বীকৃতির জন্য আবেদন প্রক্রিয়াধীর রয়েছে।

১৯২০ সালে মহাত্মা গান্ধীর স্বদেশী আন্দোলনে বিলেতী পণ্য বর্জনের ডাকে খাদি কাপড় ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। তবে গবেষকদের দাবি, ১৭ শতাব্দী থেকেই তৎকালীন ত্রিপুরার অংশ বর্তমান কুমিল্লা অঞ্চলের মানুষ খাদি কাপড় তৈরী করে নিজেদের চাহিদা মেটাতেন।